প্রতিবছরই শীতের সাথে সাথে বেড়ে যায় ডায়রিয়ার প্রকোপ। বছরের অন্যান্য সময় যে ডায়রিয়া বা কলেরা দেখা দেয়, তার থেকে শীতকালীন ডায়রিয়ার কিছুটা পার্থক্য আছে। শীতকালে শিশুদের ডায়রিয়ার মূল জীবাণু রোটাভাইরাস। আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র-আইসিডিডিআর,বি‘র তথ্য মতে চলতি বছর (২০২৫) দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আইসিডিডিআর,বিতে দিনে ভর্তি হচ্ছে আট শতাধিক শিশু। তাদের ৯০ শতাংশই রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। যা গতবারের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। আইসিডিডিআরবি’র সূত্রমতে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত ১৫ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ডায়রিয়ায় যে ভুলগুলো বিপদ ডেকে আনছে শিশুর
ঘটনা ১- আইসিডিডিআর,বির আইসিইউতে ভর্তি আছে নরসিংদীর মাধবদী থেকে আসা এক বছর বয়সী ইভা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে শিশুর মা জানান, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ডায়রিয়া শুরু হলে ইভাকে স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করেন। কম পানিতে গোলানো গাঢ় স্যালাইন। পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যায়নি; বরং খিচুনি দেখা দেয়। ০৫ জানুয়ারি আইসিডিডিআর,বি’র আইসিউতে ভর্তি করা হয়।
ঘটনা ২- গত ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৯ মাস বয়সী শিশু রাফসানকে। চিকিৎসকেরা জানান, ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর অল্প পরিমাণ পানিতে এক প্যাকেট স্যালাইন গুলে শিশুটিকে খাওয়ানো হয়। ঘনত্ব বেশি হওয়ায় শিশুটির শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে তার কিডনি কার্যকারিতা হারিয়েছে। শিশুটির শরীর ফুলে গেছে। শিশুটির মা জানান, “আগে জানলে সন্তানের এত বড় ক্ষতি হতো না”।
ডায়রিয়া চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হলো স্যালাইন পানি খাওয়ানো। স্যালাইন হলো বিভিন্ন খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ লবণ। স্যালাইন পানি ডায়রিয়া বন্ধ করে না, এটি ডায়রিয়ার ফলে শরীরে যে পানি ও লবণশূন্যতা হয়, তার ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু স্যালাইন পানি তৈরির সঠিক নিয়মাবলী না জানার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এমনকি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসহ মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়িতে ভুলভাবে স্যালাইন খাওয়ানোর কারণে অনেক শিশু রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম নিয়ে বা ‘হাইপারনেট্রিমিয়া’র লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছে বলে জানায় আইসিডিডিআরবি।
স্যালাইন তৈরি ও ব্যবহারে ভুল
স্যালাইনের প্যাকেটে কী লেখা আছে, তা বেশিরভাগ অভিভাবকই পড়ে দেখেন না। অনেকে সঠিকভাবে স্যালাইন তৈরি করতে এবং শিশুকে খাওয়াতে জানেন না। ভুল নিয়মে তৈরি করা এবং ভুলভাবে খাওয়ানো স্যালাইন যে শিশুর ক্ষতি করে, তা দেশের অনেক অভিভাবক জানেন না। ডায়রিয়ার চিকিৎসায় রাফসান বা ইভা’র অভিভাবকের মত অনেক বাবা-মায়ের ছোট্ট একটি ভুল শিশুদের ঝুঁকিতে ফেলছে, কেউবা ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে।
অনেকে অল্প পানিতে পুরো প্যাকেট বা অর্ধেক প্যাকেট স্যালাইন মিশ্রিত করেন। এটি ঠিক নয়। অবশ্যই আধা লিটার পানিতে পুরো প্যাকেট স্যালাইন মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
গরম পানি দিয়ে স্যালাইন পানি তৈরি করা যাবে না বা ফুটানো যাবে না। তৈরি এই স্যালাইন পানি ১২ ঘণ্টা পর ফেলে দিতে হবে।
ভুল পদ্ধতিতে স্যালাইন তৈরির ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে
- আধা লিটার বা ৫০০ মি.লি বিশুদ্ধ পানিতে পুরো প্যাকেটের সব উপকরণ গুলিয়ে নিতে হবে। অল্প পানির মধ্যে প্যাকেটটি মিশ্রিত করলে যে খনিজ লবণ আছে, তার মাত্রা বেড়ে যায় বা মাত্রা ঠিক থাকে না। দ্রবণে খনিজ লবণ ও পানির মাত্রা ঠিক না থাকলে রক্তের ঘনত্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। ফলে কোষ থেকে বিশেষ করে মস্তিষ্ক থেকে পানি বের হয়ে কোষ নষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
- আধা লিটার পানি না দিয়ে অল্প পানিতে তৈরি স্যালাইন পানি ঘনঘন খাওয়ানোর ফলে রক্তে লবণের মাত্রা বেড়ে হচ্ছে খিঁচুনি, এমনকি কিডনী বিকল হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। ভাগ্যক্রমে অনেকে বেঁচে গেলেও নষ্ট হচ্ছে ব্রেনের কোষ, বাধাঁগ্রস্থ হচ্ছে বেড়ে উঠা, কেউ হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, কেউ হচ্ছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আজীবন।
- স্যালাইন তৈরির ১২ ঘণ্টার বেশি সময় পর ওই স্যালাইন ব্যবহার করলে সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়, যা ডায়রিয়াকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।
সঠিক নিয়মে স্যালাইন পানি খাওয়ানোর নিয়ম
শরীরে পানি প্রতিস্থাপনের কাজটা তাড়াহুড়া করে করা যাবে না। ধীরে ধীরে করতে হবে। তাই স্যালাইন পানি একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খেতে হবে।
নবজাতককে (২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী) ১২ ঘণ্টায় আধা লিটার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। বড়দের (১০ বছরের বেশি বয়সী) ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর ১ গ্লাস (২৫০ মিলি) খাবার স্যালাইন খেতে হবে। শিশুদের ডায়রিয়া হলে, প্রতিবার পায়খানার পর শিশুর যত কেজি ওজন তত চা-চামচ বা যতটুকু পায়খানা হয়েছে আনুমানিক সেই পরিমাণ খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। শিশুদের বয়স অনুসারে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টায় আধা লিটার খাওয়াতে হবে।
- স্যালাইন খাওয়ানোর পরে শিশু বমি করলে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে আবার স্যালাইন পানি দিতে হবে। সাধারণত বমি এমনিতেই থেমে যাবে। একটু একটু করে খাওয়াতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না, বমি হলেও শরীর ঠিকই একটু না একটু পানি এবং লবণ শোষণ করে নেবে।
- স্যালাইন পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি তরল জাতীয় অন্যান্য খাবারও খাওয়াতে হবে। যেমন স্যুপ, বা বাড়িতে তৈরি তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, ভাতের মাড়। স্যালাইন পানি খাওয়ানোর সময় বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না। শিশু যদি ৬ মাসের বেশি বয়সি হয়, তাহলে অর্ধ তরল বা শক্ত খাবারও দেওয়া উচিত।
- পানিশূন্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়লে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। তবে যদি কোনো কারণে ঐ মুহূর্তে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব না হয়, বা অ্যাম্বুলেন্স আসার আগ পর্যন্ত ৫ মিনিট পরপর তার ঠোঁটে একটু একটু করে স্যালাইন পানি দিতে থাকতে হবে, যতক্ষণ না প্রস্রাবের পরিমাণ ঠিক হয়।
- ডায়রিয়া যতদিন পুরোপুরি না সারে তার আগ পর্যন্ত স্যালাইন পানি ও অন্যান্য তরল খাবার চালিয়ে পরিমাণে যেতে হবে।
প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন পাওয়া না গেলে
অনেক সময় জরুরি অবস্থায় প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন হাতের কাছে না-ও পাওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঘরেই স্যালাইন প্রস্তুত করে নেয়া যেতে পারে। এ জন্য লাগবে চিনি, লবণ ও পানি।
৬ চামচ চিনি ও আধা চামচ লবণ ১ লিটার বিশুদ্ধ পানিতে ভালোভাবে গুলে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে স্যালাইন।
সতর্কতা
— স্যালাইন তৈরির সময় উপাদানে কম বেশি করা যাবে না। চিনির পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে ডায়রিয়া বেড়ে যেতে পারে, আবার অতিরিক্ত লবণ শিশুর মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
— তবে হাতে বানানো স্যালাইনের ক্ষেত্রে পানি ১ লিটারের চাইতে সামান্য বেশি ব্যবহার করলেও সমস্যা নেই। আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, বাজারে অনেক ধরনের ফ্লেভার মিশ্রিত স্যালাইন পাওয়া যায়–তবে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসায় এসব ফ্লেভার মিশ্রিত স্যালাইন বরং ক্ষতিই বেশি করতে পারে।
— পর্যাপ্ত তরল খেতে থাকলে, কোনো ওষুধ ছাড়াই ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। না হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
লবণাক্ত এলাকায় চালের গুড়ার স্যালাইন বানানোর প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলিতে ডায়রিয়ায় মৃত্যু অব্যাহত আছে। পানীয় জলে লবণাক্ততার উপস্থিতি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এরকম পরিস্থিতিতে চালের গুড়ার স্যালাইন বাজারের ও আর এসের চেয়ে বেশি কার্যকরী হতে পারে। টিউবওয়েলের পানিতে লবণাক্ততা থাকায় চালের গুড়ার স্যালাইনে আলাদা লবণ না মেশালেও চলবে। দক্ষিণে আক্রান্ত এলাকায় চালের গুড়ার স্যালাইন অনেক শিশুর প্রাণ রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
কিভাবে চালের গুড়ার স্যালাইন বানাবেন?
-চালের গুড়ার স্যালাইন বানাতে প্রথমে একটি পরিষ্কার পাত্রে আধা সেরেরও কিছু বেশী নিরাপদ পানি নিতে হবে। এবার এতে পাঁচ চা চামচ চালের গুড়া মিশাতে হবে।
-এরপর মিশ্রণটি ৩ থেকে ৫ মিনিট চুলায় জ্বাল দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে।
-সেদ্ধ করার সময় একটি পরিষ্কার চামচ দিয়ে বার বার নাড়াতে হবে। না নাড়ালে চালের গুড়া জমে যাবে।
-মিশ্রণটি চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে দিতে হবে।(পানি লবণাক্ত হলে লবণ মেশানোর দরকার হবে না)। খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো চালের গুঁড়ার স্যালাইন।
-তৈরীর পর কোন স্যালাইন ১২ ঘন্টার বেশী রাখা উচিত নয়; ১২ ঘন্টা পর, প্রয়োজনে, আবার নতুন করে খাবার স্যালাইন তৈরী করে নিতে হবে।
ছবি: প্রথম আলো, তথ্য সূত্র: আইসিডিডিআর,বি