দেশের দুর্যোগ পরিস্থিতি

দেশে প্রতিবছর বড় ছুটিতে দুর্যোগ, দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যুসহ নানান দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়। এবারের ছুটিতেও দেশের মানুষ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার মোকাবেলা করেছে এবং করছে। নিচের বিগত কয়েকদিনের দুর্যোগ, দুর্ভোগের একটি খন্ডচিত্র তুলে ধরা হলো:

পানিতে ডুবে মৃত্যু
প্রতিবছরের মত এবারের ছুটিতেও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি। গত ১৩ থেকে ১৯ পর্যন্ত মোট ২৩ জন পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে। এর মধ্যে শিশু ২১ জন, ছেলে শিশু ১৩জন এবং মেয়ে শিশু ৮ জন। এদের মধ্যে ৫-১০ বছর বয়সের শিশু বেশি। এছাড়া একসাথে দুই জন পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৫টি এতে ১০ জন মারা গিয়েছে ।

নৌকা ডুবি
১৯ জুন কুড়িগ্রামের উলিপুরের সাদুয়া দামারহাট এলাকায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিস্তা নদীতে ২৬ জন যাত্রী নিয়ে নৌকাডুবে যায়, পরে ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত (২০ জুন) নিখোঁজ রয়েছেন ৭-৮ জন। কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিয়ের দাওয়াত খেয়ে ফেরার পথে এই দুঘর্টনা ঘটেছে।

পাহাড় ও দেয়াল ধ্বস
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে গতকাল বুধবার (১৯ জুন) ভোররাতে পাহাড় ও দেয়াল ধসের ঘটনায় আট রোহিঙ্গাসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারি বৃষ্টির কারণে পাঁচটি পৃথক শিবিরে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে আটজন রোহিঙ্গা ও স্থানীয় দুজন রয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন নারী এবং একজন শিশু ও পাঁচজন পুরুষ। এর মধ্যে একই পরিবারের ৪ জন মারা গিয়েছে। ১৮ জুন থেকে ১৯ জুন সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ক্যাম্পে ৮৯ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া গত ১৩ জুন ভোর ৪.৩০ টায় রাঙামাটি বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়ন ও মিজোরাম সিমান্তের কান্তালং এলাকায় টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্ধসে একটি ঘরের উপরে পড়ে এতে পরিবারের ৩জন মারা যায়।

বজ্রপাত
১৮-১৯ জুন এই দুইদিনে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে প্রায় ১১ জন। এছাড়া চলতিমাসে সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ৪৩ জন। এর মধ্যে শিশু ৬ জন, নারী ৯ জন এবং পুরুষ ২৮ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত (১৯ জুন) ১৫৩ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৭৫ জন।

দেশের বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি
সিলেট
অবিরাম হালকা ও ভারী বর্ষণ এবং ভারতের মেঘালয়া থেকে নেমে আসা ঢলে দ্বিতীয় বারের মতো বন্যাকবলিত হয়ে সিলেট নগরসহ ১৩ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ি, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে এরই মধ্যে ১৬ লাখের অধিক মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। গত ২০ দিনে সিলেট জেলা দ্বিতীয় দফা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সিলেটের চারটি নদীর ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এলাকার একটি পাওয়ার সাবস্টেশন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, ফলে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
এর আগে চলতি বছরের মে মাসে সিলেট জেলা পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রথম দফা বন্যা আক্রান্ত হয়, এতে প্রায় ৬৫০,০০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ১০ জুন, প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট ভূমিধসের ফলে একটি ধসে পড়া বাড়িতে আটকা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৯ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। একইসাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সকল প্রধান নদনদীসমূহের পানি বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। ফলে এ সময় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার চলমান বন্যা পরিস্থিতির অবনতি এবং নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হওয়ার আংশকা জানিয়েছে। এখন পযর্ন্ত বন্যার পানিতে ডুবে ৬ জন এবং বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে ২ জন শিশু মারা গিয়েছে।

রংপুর
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের কারণে সিলেট-মৌলভীবাজারে বন্যা আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি রংপুরের তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তায় পানি বেড়ে যাওয়ায় ও টানা বৃষ্টির কারণে তিস্তা নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দেখা দিয়েছে গবাদি পশু-পাখি নিয়ে বিপাকে পড়ার আশঙ্কা। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, ১৯ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চলের দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পেয়ে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চলমান এই বন্যা পরিস্থিতিতে এই মুহুর্তে যেসকল বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে
সংবাদপত্রে তথ্য অনুযায়ি বন্যা আক্রান্ত জেলায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে, এই সময়
• আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান পানি সরবরাহ করতে হবে।
• বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুদের ব্যবহারযোগ্য টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
• আশ্রয়কেন্দ্রে পরিষ্কার টয়লেট, নিরাপদ খাবার পানি এবং স্বাস্থ্যবিধিসহ সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া…..
• পানিতে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষায় শিশুদের নজরে রাখুন।
• শিশু বা প্রাপ্ত বয়স্ক যাদের মৃগী বা খিঁচুনি রোগ আছে তাদের পরিবারের কারো না কারো তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। চারিদিকে পানি থাকার কারণে তাদের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
• ত্রাণ কার্যক্রমে শিশুদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই মুহুর্তে রুটি বা চাপাতি বিতরণ করার চেয়ে নরম খিচুড়ি সরবরাহ করতে পারলে ভাল।
• শুকনো খাবার বিতরণ করার সময় প্রতিটি জিনিস আলাদা প্যাকেটে দিতে হবে, যেমন: আলু, চাল যেন এক প্যাকেটে দেয়া না হয়, এতে আলু নষ্ট হয়ে যাবে।
• মোমবাতি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ বেশিরভাগই মোমবাতি স্টেরিন (প্রাণী বা উদ্ভিজ্জ চর্বি) বা প্যারাফিন (পেট্রোলিয়াম বর্জ্য) থেকে তৈরি করা হয়। এটি পরিবেশ এবং শিশু উভয়ের জন্যই খারাপ। এর বিকল্প হিসেবে ব্যাটারীচালিত টর্চলাইন বা কেরোসিনে কুপি সরবরাহ করা যেতে পারে।
• নিরাপদ পানির জন্য ফিটকিরি সরবরাহে কি পরিমাণে ব্যবহার করবে তা উল্লেখ করে দিতে হবে। (যেমন: এক কলসি পানিতে সামান্য পরিমাণ ফিটকিরি পানিতে মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে তা থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে পাত্রের উপর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হবে ও তলানি ফেলে দিতে হবে।)
• ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা উপকরণ সরবরাহ করা প্রয়োজন, যেমন: নেইলকাটার, গামছা বা পাতলা সুতি কাপড়, কার্বলিক এসিড সম্বলিত সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যান্টি, চিরুনী, এবং দাঁত ব্রাশ করা পেষ্ট ও ব্রাশ।
• ওরস্যালাইন সরবরাহ করতে হবে। সার্বক্ষনিক স্বাস্থ্যকর্মী না থাকলে ওষুধ বিতরণে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে কোন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যেন না দেয়া হয় সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
• ত্রাণ সরবরাহে পলিথিন, প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

Leave a Reply