বর্তমান পরিস্থিতি
চলতি বছরের ২০ আগষ্ট থেকে দেশের ভেতরে টানা বৃষ্টি এবং উজান হতে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ১১টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সেগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। বৃষ্টি কমে আসায় দেশে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অনেক জায়গায় পানি নামতে শুরু করেছে। তবে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লার অনেক উপজেলায় পরিস্থিতি এখনো খারাপ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যমতে, চলতি মাসের এই বন্যায় দেশের ১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলার ৫৮৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে মোট ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯০১টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৫০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩০। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, ৭টি জেলায় মোট মারা গেছেন ১৮ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ৫ জন, কুমিল্লার ৪ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর জেলায় একজন করে মারা গেছেন। (সুত্রঃ সংবাদ মাধ্যম)
উন্নতির দিকে বন্যা পরিস্থিতি
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে। ২৪ আগস্ট থেকে পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনীর সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এবং ভারতের ত্রিপুরায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি কমার প্রবণতা অব্যাহত আছে। ফলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতি ২৩ আগস্ট থেকে উন্নতি হচ্ছে এবং অব্যাহত আছে। এছাড়া ২৪-২৫ আগস্ট দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানেও ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা নদী-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
অনেক এলাকায় পানি নামছে। এই মুহূর্তে আমাদের যা করা জরুরি
- পানি নামতে শুরু করেছে। এই মুহুর্তে শুকনো খাবারের চেয়ে রান্না খাবার বেশি প্রয়োজন। স্থানীয় মানুষের নেতৃত্বে পরিবার বা গ্রাম বা মহল্লাভিত্তিক বিনামূল্যের খাবার ঘরের ব্যবস্থা করে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা যেতে পারে।
- যত পানি কমছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের জন্য বাইরে থেকে তত মানুষ যাবে, এটা একটা সমস্যা তৈরি করবে এবং মানুষ ততদূরই যাবে যতদূর গেলে সে আলো থাকতে থাকতে ফেরত আসতে পারবে, এতে করে ভীড় বেশি হবে, মানুষ ছবি তুলতে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এইসব বিষয় এড়ানোর জন্য আমাদের উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এর সাথে ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করা উচিত।
- ভিড় ব্যবস্থাপনা এখন খুবই জরুরি বিষয়। সব শ্রেনী, পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এটি শুধু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্যও জরুরি।
- যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুৎ অবস্থা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- প্রায় সব এলাকার একতলা ডুবে গেছে, ফলে পানি ট্যাংক, টিউবওয়েল, সুয়ারেজ, সবগুলোই পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে। পানি ট্যাংকে জমানো আগের পানি সব ফেলে ভালো করে পরিষ্কার করে তারপর পানি সংগ্রহ করতে হবে। টিউওয়েলের পানি আধাঘন্টা অনবরত চেপে পানি ময়লা পানি ফেলে দিতে হবে।
- ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করার সময় শিশু, কিশোর, নারী, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা উপযোগী খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করতে হবে। ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করার সময় প্রতিটি জিনিস আলাদা প্যাকেটে দিতে হবে, যেমন: আলু, চাল যেন এক প্যাকেটে দেয়া না হয়, এতে আলু পচে গিয়ে চাল নষ্ট হতে পারে।
- চাল বিতরণে স্থানীয় মানুষের খাদ্যাভাস বিবেচনা করতে হবে। এলাকাভেদে কেউ আতপ চাল খায় আবার অনেকে সিদ্ধ চাল খায়। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে সমন্বয় করে চাল বিতরণের কাজ করতে হবে।
- ত্রাণ বিতরণে হাইজিন প্যাকেট দেওয়া জরুরি। এক একটি প্যাকেটে একটি চিরুনি, একটি ছোট সাবান, পেস্ট, টুথ ব্রাশ ও একটি নেল কাটার এবং একটি গামছা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- মোমবাতি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ বেশিরভাগই মোমবাতি প্যারাফিন (পেট্রোলিয়াম বর্জ্য) থেকে তৈরি করা হয়। এটি পরিবেশ, মানুষ বিশেষ করে শিশুদের জন্য বিপদজনক। এর বিকল্প হিসেবে ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট বা কেরোসিনের লন্ঠণ সরবরাহ করা যেতে পারে।
- পানি বিশুদ্ধ করার বড়ি ব্যবহারে পানিতে একটা কটু গন্ধের সৃষ্টি হয়। শিশুরা এটি পছন্দ করে না। বিকল্প হিসেবে ফিটকিরি ব্যবহার করা যায়। এক কলসি পানিতে (আন্দাজ দশ সের) এক চা চামচ গুঁড়া ফিটকিরি ভালো করে মিশিয়ে ছয় ঘণ্টা পর উপরের পানি পান ও ব্যবহার করা যাবে।
- যত দ্রুত সম্ভব গবাদি প্রানীর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে অন্য এলাকা থেকে গবাদিপশুর খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এর সাথে খুব দ্রুত গবাদি পশুর টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগী এবং ডায়াবেটিক ও উচ্চরক্তচাপ আক্রান্ত রোগী যাদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওষুধ নিতে হয় এবং শিশুদের টিকা ইত্যাদি স্বাস্থ্য বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
- ওষুধ বিতরণের সময় সাবধান হতে হবে। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মী ছাড়া কোনোভাবেই এন্টিবায়োটিক বিতরণ করা যাবে না।
- বৃষ্টি ও বন্যায় আটকে পড়া অনেকেই শিশু এবং কিশোরীদের স্বজনদের তত্ত্ববধানে রেখেছেন। পরিবার থেকে দূরে শিশু-কিশোররা নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তাদের দ্রুত পরিবারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
- এই সময় শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার বা শ্রমবাজারে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সম্ভাব্য হার, শিশুশ্রম, শিশু পাচার এবং বাল্যবিবাহ থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
- যত দ্রুত সম্ভব অস্থায়ী বিদ্যালয় বা শিশু বান্ধব কেন্দ্র/সিএফএস স্থাপন করতে হবে। এর গঠন ও পরিচালনায় বিদ্যালয়কে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্কুল বন্ধ, ঘরে পানিবন্দী হয়ে থাকা, খেলাধুলা করতে না পারা ইত্যাদির কারণে তাদের ওপর মানসিক চাপ পড়ে। এই সময়ে শিশুদের মনোসামাজিক অবস্থার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ করতে হবে দ্রুত। শিশুদের জন্য খাদ্যের চেয়ে বিনোদন বেশি জরুরি।
- এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি ইউনিয়ন, উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সম্পক্ত করে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাতে সকল ক্ষতিগ্রস্ত সহযোগিতা পায়। একই পরিবার বার বার পাবেনা। খাদ্য নয় এমন যে কোন জিনিস দেওয়ার সময় সেগুলোর ব্যবহারবিধি জানিয়ে দিতে হবে এবং পরবর্তী সহযোগিতা কখন পাবে তাও জানিয়ে দিতে হবে।
- সাপের উপদ্রব বাড়তে পারে। রাতে (যেখানে সম্ভব) মশারী দিয়ে ঘুমাতে হবে এবং মশারী ভালোভাবে গুঁজে রাখতে হবে। এন্টিভেনমের মজুদ স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছে কিনা জেনে রাখুন।
ছবি সূত্র: ডেইলি ইত্তেফাক